রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে পেশাজীবী, সামাজিক, সাংস্কৃতিকসহ এমন কোনো সংগঠন নেই, যাদের আয়োজনে প্রতিবছর জমকালো ইফতার পার্টি হয় না। করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে এবারের রমজানে ইফতার পার্টি, মাহফিল আয়োজন নিষিদ্ধ। বিভিন্ন দল, সংগঠন, সমিতি, প্রতিষ্ঠানের বিপুল টাকা সাশ্রয় হবে। করোনায় কাজ হারানো শ্রমিক, গরিব, অনাহারীদের জন্য এ টাকা ব্যয় করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। তারা বলেছেন, এতে সংকটে পড়া দরিদ্র মানুষের কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব হবে।
প্রতি রমজানে শুধু রাজনৈতিক দলগুলো নয়, তাদের অঙ্গসংগঠনগুলোও কেন্দ্রীয় থেকে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যায় পর্যন্ত ইফতার পার্টির আয়োজন করে। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিভিন্ন দলের প্রধানসহ শীর্ষ রাজনীতিকরা মাসজুড়েই ইফতারের আয়োজন করেন বিভিন্নজনের সম্মানে। করপোরেট প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে মুদিখানার মালিক সমিতি, নায়ক-গায়ক-খেলোয়াড়দের ক্লাব, ফুটপাতের শ্রমজীবী মানুষের সংগঠনও ইফতারের আয়োজন করত। ধর্মভিত্তিক সব রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের মসজিদ, মাদ্রাসায় ইফতার মাহফিল রমজানজুড়েই হতো।
এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউপি চেয়ারম্যান, মেয়র, কাউন্সিলরসহ সব পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিরাও মাসজুড়ে ইফতারের আয়োজন করে থাকেন। বিভিন্ন দলের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের নেতারাও একই কাজ করেন। পাড়া-মহল্লার বাসিন্দাদের কল্যাণ সমিতি থেকে শুরু করে ফ্ল্যাট বাড়ির মালিকদের সংগঠনও ইফতার পার্টির আয়োজক।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম মনে করেন, প্রতিবছর সামাজিক উৎসবের মতো করে ইফতার মাহফিল হয়। এবার যেহেতু সে সুযোগ নেই, তাই সবার উচিত নিজের আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী বা দরিদ্র মানুষ যারা খাদ্য সংকটে আছেন, তাদের পাশে দাঁড়ানো। এটা ধর্মীয় দিক থেকে যেমন প্রয়োজন, মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেও করা উচিত।
রমজানে দেশজুড়ে ইফতার মাহফিল কিংবা পার্টিতে কত টাকা খরচ হতো, তা নিরূপণ করা প্রায় অসম্ভব। তবে কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদের ধারণা, হাজার কোটি টাকারও বেশি ব্যয় হতো। তিনি বলেছেন, স্বাধীনতার আগে ইফতার পার্টির চল ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর একদিন পার্টি দিতেন। স্বাধীনতার অনেক পর নব্বইয়ের দশকে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ইফতার পার্টির প্রচলন শুরু হয়। গত দশকে মধ্যবিত্তের হাতে টাকা আসতে শুরু করে। বাড়তে থাকে ইফতার মাহফিলের সংখ্যা। করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো আরও ধনী হয়ে ওঠে, নব্য রাজনীতিকদের হাতেও টাকা আসে, ওই সময় থেকে ইফতার পার্টির সংখ্যা বাড়ছে।
আবুল মকসুদ সমকালকে বলেন, এবার তো ইফতার মাহফিল আয়োজন নিষিদ্ধ। করোনার কারণে গরিব, দিনমজুর মানুষও খুব কষ্টে আছেন। যারা ফি বছর নাম কামানোর জন্য ইফতার মাহফিল আয়োজন করেন, তারা এবার টাকাগুলো গরিবদের দিয়ে দিতে পারেন। এতে গরিব মানুষ কিছুটা হলেও রক্ষা পাবে। গরিবের জন্য রাতের খাবার জোগান দেওয়া ইফতার মাহফিলের চেয়ে ভালো বিকল্প হতে পারে।
করোনার কালকে দানের উৎকৃষ্ট সময় বলেছেন জাতীয় দ্বীনি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান মাওলানা ফরীদউদ্দীন মাসঊদ। তিনি বলেছেন, এমন সংকট অতীতে আসেনি। ভবিষ্যতে আসবে কিনা আল্লাহ জানেন। কোটি মানুষ মুশকিলে আছেন। এখনই তাদের পাশে দাঁড়ানোর সময়। দান করার সময়। যারা প্রতি রোজায় বহু টাকা ব্যয় করেন ইফতার আয়োজনে, তাদের মনে কী আছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা সমীচীন নয়। এবার যেহেতু ইফতার মাহফিল হচ্ছে না, সেই অর্থ গরিবের জন্য খরচ করা সর্বোৎকৃষ্ট হবে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ইফতার মাহফিল আয়োজন বন্ধ রেখেছে। দলটির অঙ্গ ও ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগ, যুব মহিলা লীগ, তাঁতী লীগও রোজায় কেন্দ্রীয় থেকে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যায়ে প্রতিবার ইফতারের আয়োজন করে। দলের কয়েকজন নেতা বলেছেন, ছোট-বড় এসব ইফতার পার্টিকে ঘিরে বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় হয়ে থাকে। এবার যেহেতু ইফতার পার্টিগুলো হচ্ছে না, তাই বেঁচে যাওয়া টাকা করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত ও কর্মহীন অসহায় ও দুস্থ মানুষের কল্যাণে ব্যয় করবেন তারা। কোনো কোনো নেতা দলীয় কিংবা নিজস্ব উদ্যোগে আগে থেকে পরিচালিত ত্রাণ কার্যক্রম চলমান রাখতে এই অর্থ দান করার সিদ্ধান্তও নিয়ে রেখেছেন।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও ১৪ দলের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিম এমপি সমকালকে বলেন, প্রতিবছর আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল রোজার মাসে ইফতার মাহফিল আয়োজন করে থাকে। ১৪ দলের অন্য শরিক দলগুলো যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী ইফতার মাহফিল করে। কিন্তু এবার করোনাভাইরাসের কারণে সব ইফতার মাহফিল বন্ধ রয়েছে। এতে ইফতার মাহফিলের যে অর্থ বেঁচে যাবে, তা করোনাভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবিলায় ব্যয় করা হবে। এটাও একটি মানবকল্যাণ ও মানবসেবা।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেছেন, জনকল্যাণমূলক ও জনসম্পৃক্ত দল হিসেবে আওয়ামী লীগ প্রথম থেকেই করোনাদুর্গত মানুষের পাশে রয়েছে। রোজার মাসে এমনকি সংকট দূর না হওয়া পর্যন্ত এই কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। আর ইফতার মাহফিলগুলো যেহেতু হচ্ছে না, সেহেতু এ থেকে সঞ্চিত অর্থ অবশ্যই অসহায় ও দুস্থ মানুষের কল্যাণে ব্যয় হবে।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির বলেন, রোজার মাসে তাদের ত্রাণ কার্যক্রম আরও জোরদার হবে। যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিল বলেছেন, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব থেকে পুরোপুরি মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত ত্রাণ কার্যক্রম চালিয়ে যাবেন তারা। ইফতার মাহফিল না হওয়ার সিদ্ধান্ত তাদের এই কার্যক্রমকে আরও এগিয়ে নেবে বলেই তার প্রত্যাশা। একই কথা বলেছেন বিএনপির কয়েকজন নেতাও। তারা বলেছেন, দলীয়ভাবে কোনো ইফতার মাহফিল করা হচ্ছে না। কোনো নেতা ব্যক্তিগত উদ্যোগের ইফতার পার্টিও করছেন না। রোজার আগেই বিএনপির উদ্যোগে ত্রাণ কার্যক্রম চলছে। অনেকেই ইফতার মাহফিলের জন্য যে টাকা ব্যয় হতো, তা ত্রাণের কাজে ব্যয় করছেন।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় রাজনীতি হচ্ছে মানুষের জীবন রক্ষা করা। বিএনপি তার সব সামর্থ্য দিয়ে মানুষ বাঁচানোর রাজনীতিই করছে। ভয়াবহ এই দুর্যোগের মধ্যে ইফতার পার্টি নিয়ে ভাবছি না। বরং এই সময়ে যার যা সক্ষমতা আছে, তাই নিয়ে অসহায় মানুষের পাশে থাকার জন্য দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। এটিই বিএনপির রাজনীতি।
দলের ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহাজাহান সমকালকে বলেন, শুধু ইফতার পার্টি বন্ধ রাখা নয়, সারাদেশে কর্মহীন, দুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন বিএনপির প্রত্যেক নেতাকর্মী।
সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির (জাপা) কো-চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা বলেছেন, তাদের দলের প্রত্যেক শাখায় আগে ইফতার মাহফিল হতো। এবার তা বন্ধ রাখা হয়েছে। প্রত্যেক নেতাকর্মী সাধ্যানুযায়ী করোনায় সংকটে পড়া মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেছেন, রমজানে মানুষ তাদের যাকাত ও ফিতরার টাকা গরিবের মধ্যে দান করেন। এ বাবদ বিশাল অঙ্কের টাকা আসে। এর বাইরে বহু রাজনৈতিক, সামাজিক ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ইফতার মাহফিল করে বড় অঙ্কের টাকা খরচ করে। এই টাকা যদি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সংগ্রহ করে দরিদ্র মানুষের মধ্যে খাদ্য বা নগদ অর্থ সহায়তা হিসেবে দেওয়ার ব্যবস্থা করা যায়, তাতে অনেক মানুষের ক্ষুধার কষ্ট লাঘব হবে।
কাজী খলীকুজ্জমান আরও বলেন, এখনও দেশে খাদ্য সংকট নেই। অর্থ সহায়তা করারও অনেক মানুষ রয়েছেন। ঘাটতি রয়েছে ব্যবস্থাপনায়, যা দ্রুত দূর করা দরকার। যে কোনো দুর্যোগকালে সরকারের সিওডি (স্ট্যান্ডিং অর্ডারস অন ডিজাস্টার) কার্যকর হয়। এর মাধ্যমে সরকার তার নিজের সহায়তার অংশসহ সামাজিক, রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক সংগঠনগুলোর কাছ থেকে অনুদান বা অর্থ সহায়তা নিতে পারে। সংশ্নিষ্টদেরও এ ক্ষেত্রে নিজে থেকে এগিয়ে আসা উচিত।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্স ফেলো নাজনিন আহমেদ মনে করেন, রাজনৈতিক সংগঠনগুলো সাধারণত অনুদান বা ব্যক্তিগতভাবে চাঁদা সংগ্রহ করে ইফতার মাহফিলের আয়োজন করে থাকে। এবার রমজানের বহু আগে থেকেই করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছে। তাই তারা টাকা সংগ্রহ করতে পেরেছেন কিনা, তা জানা নেই। তবে কেন্দ্রীয় বা আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর মধ্যে যাদের সামর্থ্য আছে, তাদের উচিত জাতীয় সংকটের এ সময়ে ইফতার মাহফিলের জন্য যে অর্থ খরচ করেন, এবার তা দিয়ে দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষকে খাদ্য ও অর্থ সহায়তা প্রদান করা। বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোরও একইভাবে এগিয়ে আসা উচিত বলে মনে করেন তিনি।