দুই দশক ধরে বেসরকারি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কোম্পানিগুলোর জবাবদিহিতার বিষয়টি আমাদের জমানার সবচেয়ে সংজ্ঞা নির্ধারনী ও বিতর্কিত ইস্যুগুলোর একটিতে পরিণত হয়। বাকস্বাধীনতা, বৈষম্য, যোগাযোগ ও সম্পদ বণ্টনের মতো ইস্যুতে ক্ষমতাধর এই প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর প্রভাব অনেক। বিশ্বজুড়ে আইনপ্রণেতা ও সুশীল সমাজ থেকে এই ক্ষমতার লাগাম টেনে ধরতে বিভিন্ন ধরণের হস্তক্ষেপ করা হয়েছে। প্রতিযোগিতা সম্পর্কিত নিয়মকানুন শক্তিশালী করা, অধিকতর স্বচ্ছতা ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ড বেশি করে মেনে চলার দাবি উঠেছে।
বেসরকারী এসব কোম্পানিগুলোর জবাবদিহিতা অধিকতর হারে নিশ্চিত করার জন্য ফেসবুকের নব সৃষ্ট ইন্ডিপেন্ডেন্ট ওভার সাইট বোর্ড (স্বাধীন পর্যবেক্ষক বোর্ড) এমনই একটি পরীক্ষামূলক পদক্ষেপ। এটির উদ্দেশ্য হলো ফেসবুক ও ইন্সটাগ্রামে সবচেয়ে জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ কনটেন্ট মডারেশন সংক্রান্ত ইস্যুগুলো মোকাবিলা করা। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শী ২০ সদস্য এই বোর্ডের সদস্য। অতীতে ফেসবুক যেসব বিষয়ে সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছে, সেসব সমালোচনা নিয়ে কাজ করতেই ফেসবুক এই পদক্ষেপ নিয়েছে। বিশেষ করে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে সবচেয়ে ভালো উপায়ে মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে পারে সে ইবিষয়ে জাতিসংঘের গাইডলাইন বাস্তবায়নকরাও এর উদ্দেশ্য।
বোর্ড সদস্যদের কেউ কেউ অতীতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, বিশেষ করে ফেসবুকের সমালোচনা করেছেন।
এসব কোম্পানি সামগ্রিকভাবে ব্যপক ক্ষমতার অধিকারী। আর আমরা যখন এক বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, সামাজিক যোগাযোগ প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ভুল তথ্য ছড়ানোর পরিণতি কী, তা আমাদের সকলের কাছে স্পষ্ট। আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও আমাদের জীবনে বেসরকারী কোম্পানিগুলোর কতটুকু স্থান থাকা উচিৎ, সেই বিষয়ে বিতর্ক করছি। আমরা হয় সকলে এই বিষয়ে কাজ করবো, ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য ও দৃষ্টিভঙ্গিকে একসাথ করে কনটেন্ট পরিচালনার এমন এক নয়া মডেল খুঁজে বের করবো, যা মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সম্মান করে, পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চর্চার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। এর মধ্যে নারী ও সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর কণ্ঠকে এগিয়ে নেওয়ার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত। নতুবা আমরা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখবো যে, অনলাইন মাধ্যম নৈরাজ্যে ভরে গেছে, হয়রানি, বিদ্বেষসূচক বক্তব্য, আর ধীরে ধীরে চরম বিশৃঙ্খলার দিকে ধাবিত হচ্ছে।
এই পর্যবেক্ষক বোর্ড আরও অর্থপূর্ণ উপায়ে কনটেন্ট মডারেশন বা বাছবিচার করার উপায় বের করতে চায়। অনেক সময় সহজতম প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়াই সবচেয়ে কঠিন হয়ে পড়ে। কোন কনটেন্ট থাকবে? আর কোন কনটেন্ট মুছে দেওয়া উচিৎ? এই সিদ্ধান্তই বা কে নিতে পারে? ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ও আলোচনার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আমরা কীভাবে এমন সব নিয়মনীতি ও চর্চা তৈরি করতে পারবো, যার মাধ্যমে এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যাবে?
এই ইস্যুগুলো সমাধানের দায়িত্বই ওভারসাইট বোর্ডকে দেওয়া হয়েছে। তবে বোঝাই যাচ্ছে যে, ফেসবুক যেভাবে কনটেন্ট মডারেট করে বা যেভাবে সিদ্ধান্ত নেয়, তা এই বোর্ড কতটুকু পরিবর্তন করতে পারবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়ে গেছে। তাছাড়া এই বোর্ড শুধুমাত্র কনটেন্ট বাছবিচার করা নিয়েই কাজ করবে। ফেসবুকের অন্যান্য সমালোচনা যেমন, ক্ষমতা সুসংহত করা, বা ইন্টারনেট কোম্পানিগুলোর বৈষম্যমূলক চর্চাও কার্যকরভাবে আমলে নেওয়া উচিৎ।এই বোর্ড একটি সৃজনশীল চর্চার ফসল। ফলে কীভাবে কাজ করতে হবে, আর কীভাবেউন্নতি হবে, তা বুঝতে সময় লাগবে। তবে এখানে মনে রাখা উচিৎ, এই বোর্ড ফেসবুকের জন্য কাজ করে না। এর সদস্যরা ফেসবুকের বেতনভোগী নন। এই বোর্ডের স্বাধীনতা বোঝা যাবে এই তথ্য জানলে যে, এই বোর্ডের সিদ্ধান্তসমূহ ফেসবুকের জন্য পরিপালন করা বাধ্যতামূলক।
এই বোর্ড এমন সব ঘটনাবলীকে প্রাধান্য দেবে যা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও বৈশ্বিকভাবে প্রভাব ফেলে। প্রথমত, ফেসবুক ও ইন্সটাগ্রাম থেকে মুছে ফেলা হয়েছে এমন কনটেন্টের বিরুদ্ধে দায়ের করা আপিল শুনবে এই বোর্ড। এরপর নিকট ভবিষ্যতে এই বোর্ড শুনানি করবে ফেসবুকের মুছে না ফেলা কনটেন্টের বিরুদ্ধে করা আপিল। এছাড়া নীতিগতভাবে সুপারিশ রাখবে বোর্ড, যে বিষয়ে প্রকাশ্যে জবাব দিতে ফেসবুক বাধ্য থাকবে।
সামগ্রিকভাবে যেহেতু বিশ্বজুড়ে সমাজ এখন অনেক বেশি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের উপর নির্ভরশীল হচ্ছে, আমাদের সামনে দায়িত্ব হলো কনটেন্ট বাছবিচার নিয়ে থাকা বিরোধ নিরসনে স্বাধীন পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করা। এটি কোনো সহজ কাজ নয়। এর জন্য কোনো নকশা নেই। বোর্ডের স্বাধীনতা বজায় রাখতে চিন্তাভাবনা করে হস্তক্ষেপ করতে হবে। বেসরকারি ক্ষমতাকে জায়েজ করার বদলে এই বোর্ড চায় ক্ষমতার বিপরীতে সত্য কথা বলতে।
এই বোর্ডে সারাবিশ্ব থেকে সদস্য নেওয়া হয়েছে। এটিও আশাবাদি হওয়ার কারণ। কোনো একক প্রতিষ্ঠান প্রায় ২০০ কোটি ফেসবুক ব্যবহারকারীর মনোভাব বা দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিনিধিত্ব করতে পারবে না। তবে এই প্রতিনিধিত্ব ও সার্বক্ষণিক আলাপ-আলোচনা এটি নিশ্চিত করবে যে, বৈচিত্র্য থাকবে ও অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা থাকবে। এসব মতামত শোনার অধিকার ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নির্দেশনার প্রতি শ্রদ্ধা থাকার বিষয়টিও নিশ্চিত করবে।
অতীতে অনলাইনে নারীর নিরাপত্তার ইস্যুতে ফেসবুক যৌক্তিকভাবেই সমালোচিত হয়েছে। বোর্ডকে তাই বাকস্বাধীনতা ও কনটেন্ট বাছবিচার বিষয়ক কৌশল নিতে হবে, যা পদ্ধতিগত নির্যাতন ও বৈষম্যকে আমলে নেয়।
ওভার সাইট বোর্ডের সদস্য সংখ্যা ৪০ জনে উন্নীত করার চিন্তাভাবনা চলছে। এটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ যে গ্লোবাল নর্থ নয় কেবল গ্লোবাল সাউথে বসবাসরত মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিও যেন সেখানে আমলে নেওয়া হয়, বিবেচনা ও শ্রদ্ধা করা হয়। কনটেন্ট মডারেশন নিয়ে নতুন কর্মকৌশল তৈরি করতে করতে আমরা চাই এক নজির সৃষ্টি করতে, যা অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কোম্পানিও অনুসরণ করতে পারে।