একটি চলচ্চিত্রের ভালোলাগা-মন্দলাগা নির্ধারিত হয় মূলত দর্শক চোখের মনস্তত্ত্ব নিয়ে। অর্থাৎ একজন দর্শক কী প্রত্যাশা বা কোন মানসিক চাহিদা নিয়ে দেখতে বসছেন, তা গুরুত্বপূর্ণ। সেই হিসেব করলে একজন চলচ্চিত্রের রিভিউ যিনি লেখেন তা তার ব্যক্তিগত উপলব্ধি ছাড়া কিছুই না। কারণ ব্যক্তি মানুষ সামগ্রিক হতে চেষ্টা করলেও ব্যক্তিসত্তা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন না। তবে ব্যক্তিসত্তার মাঝে মাঝে ব্যাপকার্থে সমর্থনও ঘটে।মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর নতুন ছবি ‘শনিবার বিকেল’ প্রদর্শিত হচ্ছে আমেরিকার একাধিক স্টেটে। আমি একটি ফিল্ম ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের কাজে যুক্তরাষ্ট্রে এসে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘শনিবার বিকেল’ ছবিটি দেখলাম। নিউইয়র্কের এস্টোরিয়ার রিগ্যাল সিনেমা টিকিট কাউন্টারে যখন ডিজিটাল পোস্টারে একজন বাংলাদেশি নির্মাতার ছবির পোস্টার ভেসে উঠলো তখন আনন্দিত হলাম। কিন্তু পূর্ণ আনন্দে খুশি হতে পারলাম না কেন? কারণ ছবিটি দেশে কোনো এক বাহানায় দেখানো হচ্ছে না, সেই প্রশ্নের জবাব জানা নেই। এই যে নিজের দেশের ছবি দেখার অভিপ্রায় থেকেও যখন দেখতে না পারা। অবশেষে দেশের বাইরে বাণিজিক পোস্টার দেখা। এর ভেতরে গর্ব হয় ঠিকই, কিন্তু আনন্দ নেওয়াটা কঠিন।
আরও পড়ুন:আইভির জন্য হাতজোড় করে ক্ষমা চাইলেন এমপি শামীম ওসমান
নির্মাতা তারেক মাসুদের একটা কথা মনে পড়ে গেল। তার মাটির ময়না যখন কানে পুরস্কার পাচ্ছে তখন ছবিটি দেশে প্রদর্শনের জন্য নিষিদ্ধ ছিল। আমার এক ইন্টারভিউতে তারেক মাসুদ সেই প্রেক্ষাপটের অনুভব নিয়ে বলছিলেন, ‘আমি সেই পুরস্কার পেয়ে আনন্দ পেয়েছি। কিন্তু পুরোভাগে সুখী হতে পারিনি। কারণ আমি তো আমার নিজের দেশে ছবিটা দেখাতে পারছি না।’ এই যে সংস্কৃতির বাঁধা। নির্মাতার ভাবনার ঘুড়িটা কেটে দেওয়ার এই যে চেষ্টা। এই চেষ্টা এদেশে দীর্ঘকালের। এর সাথে কেউ কেউ নানা যুক্তি মেশানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু এর পেছনে থাকেন গুটিকতক মুক্তমনা বিরোধী মানসিতার মানুষ। ‘শনিবার বিকেল’ ছবিটির নিয়তিতেও তাই হয়েছে।মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ছবি নিয়ে আমি এর আগে অনেক কট্টর সমালোচনা লিখেছি। বলেছি। ভালো মন্দলাগাগুলো। কিন্তু আমার দেশের একজন নির্মাতার ছবি কেন দেখানো যাবে না! একজন নির্মাতার কেন স্বাধীনভাবে নিজ দেশে তার ছবি দেখতে পারবে না। এই একটি জায়গায় কোনো বিরোধ থাকতে পারে না। থাকাটাও উচিত না। এই জায়গাটিতে ভীষণভাবে একাত্ম থাকতে ইচ্ছে করে। তাই ছবিটি দেখতে বিদেশে কোনো এক সিনেমা হলে এসে এভাবে লিখতে হবে, এটা এক ধরনের অস্বস্তি দেয়। এতটা সংকটের ছবি কী শনিবার বিকেল? প্রশ্ন জাগে!
সেই তীব্র প্রশ্ন, কৌতুহল থেকেই সিনেমা হলে ঢুকলাম। এক বেদনাহত দর্শকের মন নিয়েই হলে ঢুকলাম। ছবিটি সাম্প্রতিক একটি ঘটনার ছায়া নিয়ে নির্মাণ। এমন একটি পারসেপশন বা প্রচার করা হয়েছে গণমাধ্যমে। যা নির্মাতা কখনও বলেননি বা স্বীকার করেননি। তবে এই প্রচার কেন করা হলো?এখন ছবিটি কোনো দর্শক সেই ভাবনা থেকে দেখতে বসলে অনেক অসঙ্গতি পাবেন। কিন্তু জিম্মি গল্পের প্লট নিয়ে ফারুকী এর আগেও ছবি নির্মাণ করেছেন। সেভাবে নির্মাতার আরও একটি নতুন ছবি হিসেবে দেখলে বলা যায়, ছবিটি এক ধরনের নিরীক্ষা। তা নির্মাতা ও চিত্রগ্রাহকের দিক থেকে তো বটেই। অর্থাৎ ওয়ানশট ছবি। অন্যদিকে নির্মাতা সকল পরীক্ষিত অভিনয় শিল্পী নিয়েছেন এই ছবিতে। তবে দর্শক দৃষ্টিকোণ থেকে ভিন্ন কিছু ভাবনা থাকবেই। সেরকম কিছু অসঙ্গতি রয়েছে এ ছবিতেও। তবে মামুনুর রশীদ, জাহিদ হাসান, ইরেশ জাকের, তিশা, ইন্তেখাব দিনারের অভিনয় সাবলীলতা মুগ্ধ করে। ওয়ানশট মুভি’র সাথে আমাদের দর্শকদের তেমন পরিচয় নেই। কিন্তু ছবিটি এক ধরনের কবিতার মতো করে বলে গেছেন। ছবিটি দেখে দর্শক কৌতুহলে অনেক কিছু ভাবনা এলেও এই একটি ভাবনা কুরে খাবে, তা হলো। ঠিক কী কারণে ছবিটি দেশে প্রদর্শন করা হচ্ছে না। তার কোনো ব্যাখ্যা পাবেন না। ছবিতে বাড়তি চাকচিক্য নেই, কিন্তু বুদ্ধদেবের ছবি দেখে যারা মুগ্ধ হই আমরা, তার চেয়ে নির্মল গতিময়তা আছে এই ছবিতে। একটি কবিতার মতো ছবি এঁকেছেন নির্মাতা ফারুকী। এই ছবিটা নিয়ে অতি মাত্রার নিষিদ্ধ বটিকার আলোচনা ছবিটাকে এক অপব্যাখ্যায় নিয়ে গেছে।
ছবিটা কেন দেশে দেখানো হবে না। এটা এক সাধারণ দর্শকের কৌতুহল। ছবিটা বাংলাদেশি নির্মাতার তৈরি। দেশের মানুষদের দেখানো উচিত। তারপর না হয় ছবির ম্যারিট নিয়ে তুলকালাম আলোচনা হোক!
আরও পড়ুন:দৌলতদিয়ায় যুবককে হত্যার পর মাটিচাপা